পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা সম্পর্কে জেনে রাখুন
প্রিয় পাঠক, আপনারা পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা সম্পর্কে জানার জন্য বেশ চিন্তিত। অত্যন্ত পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি ফল হচ্ছে পেঁপে। চিন্তার কোন কারণ নেই, আমি এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে দেখানোর চেষ্টা করব কখন, কিভাবে আপনারা পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা অনুসরণ করে পেঁপে চাষ করবেন।
প্রিয় আর্টিকেল পাঠক, আপনাদের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমি পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা সম্পর্কে বেশ কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিস্তারিত জানতে আমার সাথেই থাকুন।
পেঁপে কি ?
পেঁপে CARICACEAE পরিবারের একটি উদ্ভিদের মিষ্টি রসালো ফল। এটি এমন একটি ফল যা কাঁচা এবং পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। পেঁপে অত্যন্ত মিষ্টি স্বাদের এবং ভেষজ গুণসমপূর্ণ একটি ফল। পেঁপে কম-বেশি প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়।
পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা বিষয়ে বিস্তারিত জানুন।
আমাদের দেশে পেঁপে চাষ লাভজনক হওয়ায় বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পেঁপে চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা সম্পর্কে না জানার জন্য লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ করলে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া সম্ভব। এবার আসুন জেনে নেই পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা।
চাষ পদ্ধতিঃ
জমি নির্বাচনঃ উর্বর দোআঁশ কিংবা বেলে দোআঁশ মাটি পেঁপে চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পেঁপে গাছ মোটেই জলবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই পানি নিষ্কাশন ও পানি সেচের সুবিধা জনক উঁচু জায়গায় পেঁপের চাষ ভালো হয়।
জমি তৈরিঃ
পেঁপে চাষের আগে জমি চাষ ও মই দিয়ে সুন্দরভাবে তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ২০ সেন্টিমিটার গভীর নালা থাকতে হবে। নালাসহ প্রতিটি বেড ২ মিটার চওড়া হতে হবে।
গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগঃ
চারা রোপনের কমপক্ষে ১৫ দিন আগে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার পর পর ২ ফিট গভীর গর্ত করে সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি,২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ২০ গ্রাম জিংক, ২০ গ্রাম বরিক অ্যাসিড প্রয়োগ করতে হবে। এরপর সার মিশ্রিত গর্তে পানি সেচ দিতে হবে।
তারপর চারা লাগানোর পর নতুন পাতা আসলে ইউরিয়া ও এমওপি সার ৫০ গ্রাম করে এক মাস পর পর দিতে হবে এবং গাছে ফুল ফল আসা শুরু করলে ১০০ গ্রাম করে দিতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে মাঝে মধ্যে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
চারা তৈরি ও রোপনঃ
পেঁপের চারা বীজতলা ও পলিথিন ব্যাগে তৈরি করা যায়। প্রতি হেক্টরে ১৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম বীজের দরকার হয়। বীজতলায় চারা তৈরী করার ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার সারি করে প্রতি সারিতে তিন থেকে চার সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হয়। আর পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাগে ৩ থেকে ৪টি বীজ বপন করতে হয়।
পেঁপের বীজ বপণের ১৫ থেকে২০ দিন পর চারা গজায় এবং চারাগুলো ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে জমিতে রোপনের উপযোগী হয়। ৩ থেকে ৪টি করে চারা রোপনের পর ফুল আসলে একটি স্ত্রী গাছ রেখে বাকি গাছ কেটে ফেলতে হয়। তবে ভালো পরাগায়নের জন্য বাগানে 10% পুরুষ গাছ রাখতে হয়।
পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা মেনে সঠিকভাবে পেঁপে চাষ করতে হলে মাঘ ফাল্গুন মাসে চারা রোপন করতে হবে। পড়ন্ত বিকেলে চারা রোপণ করতে হবে এবং চারা রোপনের পর পানি সেচ দিতে হবে।
পরিচর্যাঃ
পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা ভালো ফলনের জন্য অত্যন্ত জরুরী। তাই পেঁপে চাষে সফলতা পেতে হলে অবশ্যই ভালো পরিচর্যা করতে হবে। জমিকে সব সময় আগাছা মুক্ত করতে হবে এবং গোড়ার মাটি কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে। পেঁপের ফলন ও আকার সেচের উপর নির্ভর করে। তাই শুষ্ক মৌসুমের প্রয়োজনীয় পানি সেচ দিতে হবে। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমে যাতে জমিতে পানি না জমে সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনঃ
পেঁপে গাছের রোগ বালাই এর মধ্যে কাণ্ডপচা, ঢলে পড়া, এনথ্রাকনোজ, মোজাইক ও পাতা কোকড়ানো অন্যতম। এছাড়াও পোকার মধ্যে মিলিবাগ অন্যতম।
ঢলে পড়া ও কান্ডপচা রোগ দমনঃ
সাধারণত মাটি স্যাঁতস্যাঁতে ও ভিজা থাকলে ঢলে পড়া ও কান্ডপচা রোগ দেখা দেয়। প্রতিকার হিসাবে রোগাক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে রিডোমিল এম জেড ৭২ প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে মিশিয়ে সাত দিন পর পর গাছের গোড়ায় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।
মোজাইক রোগঃ
এটি ভাইরাস জনিত একটি রোগ। এই রোগ হলে গাছের পাতায় হলুদ রঙের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ৫৬ ইসি ২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
মিলিবাগ পোকাঃ
বর্তমানে মিলিবাগ পোকা পেঁপের জন্য দারুন ক্ষতিকর। আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডার এর মত আবরণ পড়ে এবং গাছ ধীরে ধীরে মারা যায়। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে অ্যাডমায়ার ২০০ এসএল ০.২৫ মিলিলিটার হারে বা সাবানের পানি ৫ গ্রাম মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন পর পর ৩-৪বার স্প্রে করতে হবে।
ফসল তোলাঃ
সবজি হিসেবে কচি ফল সংগ্রহ করা হয়। আর পাকানোর জন্য ফলের রঙ হালকা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হয়।
পেঁপে চাষের উপযুক্ত সময়।
পেঁপে আমাদের দেশের সবচেয়ে সুপরিচিত এবং পুষ্টিকর একটি ফল। মাঘ-ফাল্গুন মাস হচ্ছে পেঁপে চাষের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
পেঁপে চাষে সেচের উপকারিতা।
পেঁপে চাষে সেচের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। কেননা, শুষ্ক মৌসুমে সেচের ওপর পেঁপের ফুল, ফল ও সাইজ নির্ভর করে। পেঁপের জমিতে পানি সেচের মাধ্যমে মাটিতে জো রাখতে পারলে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া যায়।
পেঁপে চাষ কি সত্যিই লাভজনক ?
বাংলাদেশের প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনায় পেঁপে চাষের খরচ খুব কম। সে কারণে পেঁপে চাষ খুবই লাভজনক।
এক বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ করলে কত টাকা লাভ হয় ?
পেঁপের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা অনুসরণ করে পেঁপে চাষ করলে আপনি সহজে বুঝতে পারবেন এটি একটি লাভজনক ফসল। প্রতি বিঘা জমিতে লিজের টাকাসহ প্রায় খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আর অনায়াসে পেঁপে বিক্রি করা যায় প্রায় দেড় লক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকার। অর্থাৎ এক বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ করে কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ করা সম্ভব।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url