পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখুন
প্রিয় পাঠক ,আপনারা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার কখন, কিভাবে দেখতে যাবেন সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিত । ঐতিহাসিক নিদর্শনে ভরপুর নওগাঁর সোমপুর বৌদ্ধবিহার। চিন্তার কোন কারণ নেই, আমি এই পোস্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে দেখানোর চেষ্টা করব কখন ,কিভাবে আপনারা নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দেখতে যাবেন ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার কোথায় অবস্থিত ?
এটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের অপর নাম কি ?
এর অপর নাম সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার কত সালে কে নির্মাণ করেন ?
বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার সোমপুর বিহার বর্তমান সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার । এটি নির্মিত হয় অষ্টম শতকের শেষের দিকে অথবা নবম শতকের শুরুর দিকে (৭৮১-৮২১) । এটির নির্মাতা ছিলেন পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার সম্পর্কে জেনে রাখুন অজানা সব ইতিহাস ।
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন । এই উপমহাদেশের হাজার বছরের সাক্ষী এই নিদর্শন । নওগাঁ শহর থেকে এই বিহারের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। অনেকের ধারণা,কালক্রমে বালি আর মাটিচাপা পড়তে পড়তে বিহারটি অনেকটা পাহাড়ের আকৃতি ধারণ করেছিল বলেই হয়তো স্থানটি যুগে যুগে পাহাড়পুর বিহার নামে পরিচিতি লাভ করতে পারে ।
১৮৭৯ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার করেন । ইউনেস্কোর মতে, এটি দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার । ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে মর্যাদা দেয়।এটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অতি বিখ্যাত ধর্ম ও শিল্পচর্চা কেন্দ্র ছিল ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার কেন বিখ্যাত ?
বাংলাদেশের মানব সভ্যতার ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলোর মধ্যে সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার অন্যতম । এই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার পৃথিবীর অন্যতম একটি বৌদ্ধবিহার । এই বিহার প্রায় ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্ম ও শিল্পচর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল । এই বিহারটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হতো ।
এই পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করতে আসতেন । এক কালে এই বিহারের খ্যাতি নালন্দা কেউ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে একে বাংলাদেশের নালন্দা বলে অভিহিত করা হয় । আর সে কারণে, এই বিহার পৃথিবী বিখ্যাত ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে কি কি আছে ?
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে মোট ১৭৭ টি কক্ষ রয়েছে । যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন । বিহারের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি মন্দির । যার দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট প্রস্থ ৩৫০ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট । মন্দিরের বাইরে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি এবং বেশ কিছু পোড়ামাটির ফলক রয়েছে । এছাড়াও এই বিহারের আশেপাশে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে । সেগুলো হলোঃ স্নানঘাট, গন্ধেশ্বরী মন্দির, জাদুঘর ,সত্যপীরের ভিটা ইত্যাদি ।
সত্যপীরের ভিটা কোথায় অবস্থিত ?
সত্যপীরের ভিটা বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে পাহাড়পুর জাদুঘরের পাশে অবস্থিত । এটি একটি প্রাচীন বিহার। যা বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি স্থাপনা ।
সীতাকোট বৌদ্ধবিহার কত সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল ?
আবুল কালাম মোঃ জাকারিয়ার উদ্যোগে ও জেলা পরিষদের অর্থায়নে এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কারিগরি সহায়তায় ১৯৬৮ সালে সীতাকোট বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরেও খনন কার্য চালানো হয়েছিল এই বিহারে ।
বৌদ্ধবিহার শব্দের অর্থ কি ?
বৌদ্ধ বিহার হলো বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের মঠ বা শিক্ষালয় । এটি বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বাসস্থান, ধর্মচর্চা ও ধ্যান করার স্থান, এবং বৌদ্ধ শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে অত্যন্ত সুপরিচিত ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার কে আবিষ্কার করেন ?
ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পর সকল স্থানে জরিপ কার্য শুরু হয় । পূর্ব ভারতে জরিপ কার্য পরিচালনা করেন বুকানন হ্যামিলটন । তিনি এই বৌদ্ধবিহার সর্বপ্রথম পরিদর্শন করেন । তারপর পরিদর্শনে আসেন ওয়েস্টম্যাকট । তারই ধারাবাহিকতায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার করেন ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কেন নির্মাণ করেন ?
বৈদিক যুগে গুরুগৃহকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল । পরবর্তীতে প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক বিবর্তন নিয়ে আসে সোমপুর বৌদ্ধবিহার । বিশ্বমানের শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে সোমপুর বিহার যে অনন্য অবদান রেখেছিল তা আজ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে ।
ভারতবর্ষের নালন্দা, শালবন ও তক্ষশীলার ন্যায় সোমপুর বিহার ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাদান ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র বিন্দু ছিল । এখানে চীন, তিব্বতসহ বহু দেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিদ্যার্জনের জন্য আসতেন । তাই বরেন্দ্র অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মচর্চার আদি বিদ্যাপীঠ হিসাবে সোমপুর বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কে ধ্বংস করেন ?
মহাপন্ডিত বোধি ভদ্র সোমপুর বিহারের প্রধান ছিলেন । খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর । মহাপন্ডিত বোধি ভদ্র ও অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করতেন । তাদের লেখা বহু গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে । পরবর্তীতে পাল বংশের পতনের পর ধীরে ধীরে সোমপুর বিহারের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি লুপ্ত হতে থাকে ।
এই সময়ে সম্ভবত সোমপুর বিহার ধ্বংসের জন্য আক্রমণ করা হয় এবং শেষবারের মতো সোমপুর বিহারের পতন হয় । একসময় অযত্ন , অবহেলা ও প্রাকৃতিক কারণে জ্ঞানের এই প্রদীপটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায় । বিলীন হয়ে যায় তার সকল গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url