সোমালিয় জলদস্যু সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখুন

প্রিয় পাঠক, সোমালিয়ার জলদস্যুতা নিয়ে আপনারা বেশ চিন্তিত। সোমালিয়া উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত একটি রাষ্ট্র। দেশটির দারিদ্রতার প্রধান কারণ গৃহযুদ্ধ। চিন্তার কোন কারণ নেই, আমি এই পোস্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে দেখানোর চেষ্টা করব সোমালিয় জলদস্যুদের উত্থান কখন,কিভাবে ঘটেছিল।

সোমালিয় জলদস্যু সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে রাখুন

প্রিয় আর্টিকেল পাঠক, আপনাদের সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আমি সোমালিয়ার জলদস্যুতা সম্পর্কে বেশ কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিস্তারিত জানতে আমার সাথেই থাকুন।

জলদস্যু কারা ? 

জলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জলদস্যু বলে। আবার অন্যভাবে বলতে গেলে জলদস্যু বলতে সমুদ্রের অভ্যন্তরে ডাকাতি বা কাউকে জিম্মি করে অর্থ আদায় বা নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। জলদস্যুতা আন্তর্জাতিক আইনে একটি নির্দিষ্ট অপরাধের নাম।

জেনে রাখা  ভালো কারা সোমালিয় জলদস্যু ?

আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি দেশ সোমালিয়া। দেশটির কথা মনে হলেই যে জিনিসটি সর্ব প্রথম সামনে চলে আসে সেটি হচ্ছে তাদের বর্বরতার ইতিহাস। যারা সমুদ্রপথে জাহাজ অপহরণ করে নাবিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে,তারাই সোমালীয় জলদস্যু। বর্তমানে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর  সহযোগিতায় সোমালিয়া উপকূলে জাহাজ চলাচলের জন্য কিছুটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তারপরেও থেমে থাকেনি সোমালিয় জলদস্যু বাহিনীর অবর্ণনীয় বর্বরতা।

 কেন্দ্রীয় সরকার না থাকার কারণে, দেশটির উপকূল জুড়ে জলদস্যুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জলদস্যু বাহিনীর অধিকাংশই হচ্ছে সোমালিও যুবক। জলদস্যুদের ৮০ শতাংশই সোমালিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের বিবাদপূর্ণ এলাকার এবং বাকি ২০ শতাংশ হচ্ছে স্থিতিশীল উত্তর অঞ্চলের। সোমালিয় জলদস্যুরা মোট তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এই জলদস্যুতার মত কাজগুলো সম্পূর্ণ করে থাকেন। ভাগগুলো হলোঃ

১। উপকূলের জেলে সম্প্রদায়ের লোকজনঃ এরা মূলত জলদস্যু চক্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য।

২। সাবেক সেনা কর্মকর্তাঃ এরা পূর্ববর্তী সরকারের সৈনিক বা সেনা কর্মকর্তা।

৩। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দলঃ  এরা মূলত জলদস্যুদের প্রযুক্তিগত সহায়তা করে থাকেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলদস্যুদের প্রতিটি দলে এই তিন ধরনের সদস্য থাকেন। হর্ন অব আফ্রিকা হিসেবে পরিচিত জলভাগের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় সহজে সোমালিয় জলদস্যুরা এই পথে চলাচলকারী সব নৌযানকে আক্রমণ করতে পারে।

কিভাবে ঘটলো সোমালিয় জলদস্যুদের উত্থান 

বেশ কিছুদিন যাবত স্থিমিত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সোমালিয়া জলদস্যু বাহিনী ব্যাপক বর্বরতা শুরু করেছে। গত ১২ই মার্চ এমবি আব্দুল্লা নামে বাংলাদেশ একটি জাহাজ ছিনতাই করে ২৩ নাবিককে জিম্মি করেছে। সাম্প্রতিক সময় গুলোতে লোহিত সাগরে হুতিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরে সোমালিয় জলদস্যু আবার মাথাচাড়া দেয়া শুরু করেছে।

ইতালিয়ান উপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়া রাষ্ট্রের জন্ম। জন্মের পর থেকে দেশটির আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো থাকলেও ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পর ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। পরের প্রায় দুই দশক দেশটিতে কোন কার্যকর সরকার ব্যবস্থাই ছিল না।

ওই সময়ে আফ্রিকার দীর্ঘতম উপকূলবেষ্টিত দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোন বাহিনী ছিল না। এই সুযোগে ওই অঞ্চলে বিদেশী মাছ ধরা নৌযানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে জলদস্যুতা বেঁচে নেয়। তাছাড়া মাছ শিকারের চাইতে জলদস্যুতায় আয়ের পরিমাণও বেশি এভাবে উত্থান ঘটে সোমালিয় জলদস্যুদের।

ফলে তাদের দৌরাত্বে অতিষ্ঠ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই পথে তাদের সামরিক শক্তির উপস্থিতি বাড়ায় এবং তাদের  দৌরাত্ব আবার কমতে থাকে। সাম্প্রতিক সময় গুলোতে হুতিদের নিয়ে নজর একটু বেশি থাকার সুযোগ এরা আবার তারা মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে।

সোমালীয় জলদস্যুুদের কবলে থাকা বাংলাদেশি জাহাজ এখন কোথায় ?

সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে থাকা বাংলাদেশী জাহাজ এখন কোথায় তা সুনির্দিষ্ট করে বলা বেশ কঠিন। কেননা ২৩ নাবিকসহ ভারত মহাসাগরে ছিনতাই হওয়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটির অবস্থান কৌশলগত কারণে বারবার বদল করছে সোমালিয় জলদস্যুরা।

গত ১২ ই মার্চ সোমালিয় উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাই করে সোমালিয় জলদস্যরা। তিনদিনের মাথায় জাহাজটিকে সোমালিয় উপকূলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফা স্থান পরিবর্তন করে জাহাজটি গত শুক্রবার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙর করে রাখা হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ছিনতাই হওয়া জাহাজটি হয়তো বর্তমানে গদভজিরান বা তার নিকটবর্তী কোন স্থানে অবস্থান করছে।

সোমালিয় জলদস্যুরা কেন এত শক্তিশালী ?

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, জলদস্যুতা এখন সোমালিও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। শুরুতে তারা জাহাজ জিম্মি এবং মুক্তিপণের অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু অস্ত্র ও মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার করলেও বর্তমানে তারা শক্তিশালী ইঞ্জিন চালিত স্টিলের নৌকা, স্পিডবোট, ট্রাকিং ডিভাইসসহ আধুনিক শক্তিশালী অস্ত্র গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে। 

আধুনিক জিপিএস পদ্ধতির প্রয়োগ এবং বাণিজ্যিক জাহাজের রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে কাজে লাগায় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের দল। আক্রমণ করে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। তাতে ব্যবহৃত হয় AK-47,TT-33, RPG-7, AKM, RPK এবং PK ইত্যাদির মত শক্তিশালী ভারী অস্ত্রশস্ত্র। এছাড়াও ব্যবহার করে F1 ও RGD-5 এর মতো হাত বোমাও।

জলদস্যুদের রাজধানী কোথায় ?

ইয়েল শহরটি সোমালিয় জলদস্যুদের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। যার এক দিকে রয়েছে ভারত মহাসাগরের নীল উষ্ণ জলের আচ্ছাদন এবং অন্যদিকে রয়েছে বৃহৎ নুগাল পর্বত। একসময়ের প্রাচীন এই শহরটি বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে। বিদেশি ট্রলারের মাধ্যমে অবৈধভাবে মাছ আহরণ করার কারণে এখানকার সমুদ্র অনেকটা মৎস্যহীন হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় এখানকার মাটি অনেকটা পাথরে হওয়াই কৃষি কাজের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী।

তাই, এখানকার বাসিন্দারা ভরণপোষণের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে জলদস্যুতাকে বেছে নিয়েছেন। এখানকার হাজার হাজার বাসিন্দারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িত। এখানে কি পরিমান জলদস্যু রয়েছে তার সঠিক কোন হিসাব আজ পর্যন্ত নেই।

সোমালিয় জলদস্যুদের পিছনে কারা রয়েছে ?

সোমালীয় জলদস্যদের পিছনে কারা রয়েছে তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা বেশ কঠিন। তবে কেন তারা জলদস্য হয়ে উঠলো ? কেনই বা সোমালিও জলদস্যুদের বিপুল জনপ্রিয়তা ? কেনই বা তাদের বলা হয় সোমালিয় জলরক্ষী। আজ আমি এই বিষয়গুলা নিয়ে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

সোমালিয়ার উপকূলের পানি ছিল আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ এখানকার পানিতে বিচরণ করত টোনা, মার্লিনসহ নামিদামি মাছেরা। একসময় বিদেশী মৎস্য শিকারীরা আধুনিক নৌযান ও পানির গভীরে ফেলবার মত জাল দিয়ে সোমালিয় মৎস্য সম্পদ চুরি করতো । এতে বেকার হয়ে পড়ল সোমালিয়ার হাজার হাজার সামুদ্রিক জেলেরা।

 এছাড়াও ১৯৯১ সালের পর দেশে কোন কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। ক্ষুধা ও দারিদ্র পীড়িত মানুষ তখন সহজে অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে জলদস্যুতা বেছে নিল। মূলত এই দুইটি কারণই সোমালিয়দের জলদস্যু হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে আমার মতে, সোমালিয়দের এই বর্বরতার মত পথ বেছে নেওয়া মোটেই ঠিক হয়নি। 

আধুনিক বিশ্বে অর্থ উপার্জনের এই পথ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি আশা করব, জলদস্যরা এই অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন থেকে ফিরে আসবেন এবং পৃথিবীর অবারিত এই বিশাল জলধারাগুলো সবার জন্য নিরাপদ হয়ে উঠবে এমনটাই কামনা করি। 

এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজ কর্তৃপক্ষের সাথে কি যোগাযোগ শুরু করেছে সোমালিয় জলদস্যুরা

এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি অপহরণের আট দিন পর নানা নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে জাহাজ মালিক পক্ষের সাথে তারা প্রথম যোগাযোগ শুরু করেছে বুধবার দুপুর দুইটার দিকে। জাহাজ ও ২৩ নাবিকদের উদ্ধারের ব্যাপারে আলোচনা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে। খুব শীঘ্রই একটা সমঝোতায় আসবে বলে এমনটা আশা করা যায়। সাথে সাথে হতভাগ্য  ২৩ নাবিকদের পরিবারে ফিরে আসবে স্বস্তির নিশ্বাস। তবে ইতিমধ্যে জাহাজটি বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এখন যারা যোগাযোগ করছে তারাই মূল হোতা বলে দাবি জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষের।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪