গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে রাখুন
প্রিয় পাঠক, আপনারা গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানার জন্য বেশ চিন্তিত। বর্তমান সময়ে মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে গবাদি পশু পালনের কোন বিকল্প নেই। চিন্তার কোন কারণ নেই, আমি এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতির সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করব।
প্রিয় আর্টিকেল পাঠক, আপনাদের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমি গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতির সম্পর্কে বেশ কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিস্তারিত জানতে আমার সাথেই থাকুন।
পশু পালন কি ?
পশুপালন হচ্ছে কৃষির একটি শাখা। যেখানে মাংস, দুধ, ডিম এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের জন্য পশুপালন ও প্রজনন করা হয়। মূলত পশু পালন বলতে গবাদি পশু পালন এবং উন্নত প্রজনন ব্যবস্থাকে বোঝায়। যার মাধ্যমে গবাদি পশুর বাড়তি যত্ন করা হয় এবং গবাদি পশু খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে।
আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ জীবিকা নির্বাহে পশু পালনের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। গবাদি পশু আমাদেরকে নানান ধরনের খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে, যা উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। অতএব তাদের প্রতি আমাদের অনেক যত্নও মনোযোগ দিতে হবে।
গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।
গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি পশুপালনের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আমাদের মধ্যে গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ না করার ফলে গবাদি পশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
তাই গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে তা অনুসরণ করতে হবে। পবিত্র ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণ শুরু করলে বেশ লাভবান হওয়া যায়। গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে সফলতা লাভ করতে চাইলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
১। গরু নির্বাচনঃ দেড় থেকে দুই বছরের সংকর জাতের ষাঁড় বাছুর নির্বাচন করতে হবে। বুক চওড়া, চামড়া ঢিলা, প্রশস্ত কোমর, উঁচু, লম্বা ও রোগমুক্ত গরু নির্বাচন করতে হবে।
২। বাসস্থান নির্মাণঃ প্রতিটি গরুর জন্য ৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট প্রস্থ জায়গার প্রয়োজন হয়। ঘরের ভেতর যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মেঝে ঢালু রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতর খাদ্য ও পানির পাত্র থাকতে হবে।
৩। কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবেঃ গরু ক্রয় করার পর পরই গরুকে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর কৃমিনাশকওষুধ খাওয়াতে হবে।
৪। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা প্রদানঃ গরুর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। গরুর মল, জিহ্বা, পায়ের ক্ষুর, শরীরের তাপ ও নাড়ীর স্পন্দন নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে। পশু চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদান করতে হবে।
৫। পর্যাপ্ত সুষম খাবার খাওয়াতে হবেঃ সঠিক পরিমাণে পুষ্টি সমৃদ্ধ কাঁচা ঘাস খাওয়ালে প্রতিদিন একটি ষাঁড় বাছুরের ওজন এক কেজি পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রতিদিন ১০০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড় গরুকে ইউরিয়া মিশ্রিত প্রক্রিয়াজাত খড় দুই থেকে তিন কেজি,কাচা নেপিয়ার ঘাস ৮ থেকে ১০ কেজি, চালের কুড়ো ৫০০ গ্রাম, গমের ভুষি ৫০০ গ্রাম, তিলের খৈল ২৫০ গ্রাম, লবণ ৫০ গ্রাম এবং চিটাগুড় ২৫০ গ্রাম খাওয়াতে হবে। সাথে পর্যাপ্ত পানি পান করাতে হবে।
উপরে উল্লেখিত গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করে গবাদি পশু লালন পালন করলে অবশ্যই আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে।
গরু মোটাতাজাকরণে দানাদার খাদ্য তালিকা।
গবাদি পশুর মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে গরু মোটাতাজাকরণের কোন বিকল্প নেই। নিম্নে আমি গরু মোটাতাজাকরণে দানাদার খাদ্য তালিকা উল্লেখ করেছি যা ডঃ শহিদুল হক খান স্যার উদ্ভাবন করেছেন।
দানাদার খাদ্য তালিকা - ১
গম ভাঙ্গা ১৫০ গ্রাম, গমের ভুসি ২৫০ গ্রাম, ধানের ভুসি ২৮০ গ্রাম, মসুর ভুসি ১০০ গ্রাম, সরিষার খৈল ১৪০ গ্রাম, মাছের গুড়া ৫০ গ্রাম, লবণ ০৫ গ্রাম, ঝিনুকের পাউডার ২৫ গ্রাম, শুষ্ক খাদ্য ৯০০ গ্রাম, মেটাবলিক শক্তি ১০.৮৮ গ্রাম এবং আমিষ ১৮৩ গ্রাম।
দানাদার খাদ্য তালিকা -২
চাল ভাঙ্গা ২০০ গ্রাম, গমের ভূষি ৩০০ গ্রাম, ধানের ভুষি ২৩০ গ্রাম, সরিষার খৈল ১৯০ গ্রাম, মাছের গুড়া ৫০ গ্রাম, লবণ ০৫ গ্রাম, ঝিনুকের পাউডার ২৫ গ্রাম, শুষ্ক খাদ্য ৯০০ গ্রাম, মেটাবলিক শক্তি ১১.২৬ গ্রাম এবং আমিষ ১৮৭ গ্রাম।
উপরে দেয়া খাদ্য তালিকার যে কোন একটি আপনি গ্রহণ করতে পারেন। আর এভাবে গবাদি পশুকে খাওয়াতে পারলে অবশ্যই আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে।
গরু মোটাতাজাকরণের ঔষধের নাম।
গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতির সম্পর্কে বিশদভাবে না জেনে আমাদের দেশের অনেক খামারিরা পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে স্টেরয়েড গ্রুপের বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন। কৃত্রিমভাবে গরুর মাংস বৃদ্ধির জন্য ট্যাবলেট খাওয়ানো হয় অথবা ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এতে গরুর মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি হয়। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
তবে গ্রোথ হরমোন বা স্টেরয়েড ছাড়াও জৈব পদ্ধতিতে সুষম খাদ্য ও হজম শক্তি বৃদ্ধিকারক ওষুধ খাওয়ানোর ফলে খুব সহজে গরু মোটাতাজাকরণ করা সম্ভব।
প্রোবায়োটিকস, প্রিবায়োটিকস ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট এগুলো জৈব পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ ঔষধ। এগুলো গরুর পাকস্থলির মাইক্রোফ্লোরা ও উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উন্নতি ঘটায়। ফলে গরুর দীর্ঘদিন খাবারে রুচি ভালো থাকে এবং গরুর মাংস বৃদ্ধি পায়। আপনিও মনে চাইলে এগুলো গরুকে খাওয়াতে পারেন।
যেমনঃ বায়োলাক,বোলাস,বায়োগাট পাউডার ইত্যাদি। গবাদি পশু পালন ও মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, মিনারেল ফুড সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে।
গবাদি পশু পালনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
গবাদি পশুর চামড়াও পশম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দুটি উপাদান। চামড়া দ্বারা জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেল্ট থেকে শুরু করে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করা হয়। আর পশমের সাহায্য শীত নিবারণকারী পোশাক তৈরি করা হয়। এছাড়াও পশুর হাড়, মগজ ওষুধ তৈরিতে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। এমনকি পশু জবেহ করার পর তার অন্ত্রের অংশসমূহ জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে গবাদি পশুর হাড় ও শিং কুচি ফসলে ব্যাপক ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বোপরি মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে গবাদি পশুর কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীতে গবাদি পশুই একমাত্র মাংস উৎপাদনের আধার। আজ পর্যন্ত এর কোন বিকল্প আবিষ্কার হয় নাই। তাই গবাদি পশু পালনের গুরুত্ব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url